বাঘাইছড়ি উপজেলার ভূ-প্রকৃতি ও ভৌগলিক অবস্থান এই উপজেলার মানুষের ভাষা ও সংস্কৃতি গঠনেভূমিকা রেখেছে। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলে অবস্থিত এই উপজেলাকে ঘিরেরয়েছে ভারতের ত্রিপুরা, মিজোরাম রাজ্যও চট্টগ্রাম বিভাগের অন্যান্যউপজেলাসমূহ। এখানে ভাষার মূল বৈশিষ্ট্য বাংলাদেশের অন্যান্য উপজেলা থেকে একটু ভিন্নতবুও কিছুটা বৈচিত্র্য খুঁজে পাওয়া যায়। যেমন কথ্য ভাষায় মহাপ্রাণধ্বনিঅনেকাংশে অনুপস্থিত, অর্থাৎ ভাষা সহজীকরণের প্রবণতা রয়েছে। বাঘাইছড়িউপজেলার আঞ্চলিক ভাষার সাথে সন্নিহিত চাকমা ভাষারসাযুজ্য রয়েছে। সাজেক ভ্যালীর পাদদেশে বাঘাইছড়ির মানুষের আচার-আচরণ, খাদ্যাভ্যাস, ভাষা, সংস্কৃতিতে ব্যাপকপ্রভাব ফেলেছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।বাঘাইছড়ি উপজেলায় প্রায় ৮ টি উপজাতি বসবাস করে। এখানে প্রত্যেকটি উপজাতি সম্প্রদায়ের নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি রয়েছে।
উপজাতীয় সম্প্রদায়গুলি যথাক্রকে (১) চাকমা (২) বার্মা (৩) মারমা (৪) ত্রিপুরা (৫) পাংখুয়া (৬) লুসাই (৭) রাখাইন এবং (৮) খিয়াং
এই এলাকার ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায়যে বাঘাইছড়ির সভ্যতা বহুপ্রাচীন। এই এলাকায় প্রাপ্ত প্রত্নতাত্ত্বিকনিদর্শন প্রাচীন সভ্যতার বাহক হিসেবে দেদীপ্যমান।
যেসব সরকারী সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা বাঘাইছড়িতে কাজ করছে সেগুলো হলোঃ
* উপজেলা শিল্পকলা একাডেমী, বাঘাইছড়ি
* সরকারী গণ গ্রন্থাগার, বাঘাইছড়ি
ভাষা
চাকমা বর্ণমালা
জন বৈচিত্র্যর এক অনন্য মিলন ক্ষেত্র রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলার বাঘাইছড়ি উপজেলা। এখানে দশ ভাষাভাষি এগারটি জাতি সত্ত্বার বসবাস রয়েছে। এরা হচ্ছে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, তঞ্চঙ্গ্যা, ম্রো, চাক, খিয়াং, খুমী, পাংখোয়া, বোম ও লুসাই। ভাষা ও সংস্কৃতির বিচারে এক জাতিসত্ত্বা অন্য জাতিসত্ত্বা থেকে স্বতন্ত্র। নৃতাত্ত্বিক বিচারে তাদের সকলেই মঙ্গোলীয় জনগোষ্ঠিভুক্ত। সংখ্যাগরিষ্ঠতার দিক থেকে ‘চাকমা’ হচ্ছে প্রধান জাতিসত্ত্বা। তাদের পরেই মারমা, ত্রিপুরা ও তঞ্চঙ্গ্যাদের অবস্থান। অন্যান্য সাতটি জাতিসত্ত্বার সংখ্যা অতি নগন্য। তারা রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলার মোট জনসংখ্যার ১.২৭% মাত্র।
এতদঞ্চলে বসবাসরত প্রত্যেক জাতিসত্ত্বার রয়েছে নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি। এদের মধ্যে চাকমাদের রয়েছে নিজস্ব বর্ণমালা। মারমারা বর্মী বর্ণমালায় লেখার কাজ চালায়। তাদের লোক সাহিত্যও বেশ সমৃদ্ধ। লোক সাহিত্যের মধ্যে রয়েছে প্রবাদ-প্রবচন (ডাগকধা), ধাঁধাঁ (বানা), লোককাহিনী, ছড়া উভগীদ ইত্যাদি। এগুলোর ব্যবহার ও রচনা শৈলী বেশ চমকপ্রদ। লোককাহিনীর বুননেও উৎকর্ষতার ছাপ রয়েছে। চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরারা আধুনিক সাহিত্য চর্চায়ও অনেকটা এগিয়েছে। তারা নিজেদের ভাষায় কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ ইত্যাদি রচনা করছে।
চাকমা ও তঞ্চঙ্গ্যাদের ভাষা সমগোত্রের এবং ভাষা রীতিতে বেশ মিল রয়েছে। দু’টো ভাষায় Indo-Aryan বা হিন্দ-আর্য শাখার অন্তর্ভূক্ত। মারমারা বর্মী ভাষায় কথা বলে। মারমা এবং ম্রোদের ভাষা তিববতী-বর্মী ভাষার দলভুক্ত। ত্রিপুরা ভাষাকে ভারতবর্ষে ‘ককবরক’ নামে অভিহিত করা হয়। এ ভাষা Sino-Tibetan গোত্রভূক্ত। অন্যদিকে খিয়াং, লুসাই, পাংখোয়া, বম ও খুমীদের ভাষা কুকী-চীন (Kuki-Chin) দলের অন্তর্ভূক্ত। চাক ভাষার সাথে উত্তর বার্মার Kudu এবং পূর্ব ভারতের মনিপুরের Andro ভাষার মিল ও ঐতিহাসিক যোগসূত্র রয়েছে।
নিম্নে কতিপয় বাংলা শব্দের সাথে উপজাতীয় শব্দের সংগ্রহ তুলে ধরা হলোঃ-
বাংলা | এক | সূর্য | আকাশ | পাহাড় | নদী | পৃথিবী | মানুষ | চোখ | গরু | ভাত |
চাকমা | এক | বেল | আঘাচ | মুর | গাং | পিত্থিমী | মানুচ | চোক | গরু | ভাত |
মারমা | তই | নিং | পংখাং | তং | খ্যং | কবা | লু | ম্যাচি | নোয়া | থামাং |
ত্রিপুরা | সা | সাল | নগা | হাপং/হাচৌ | তইমা | হা | বরক | - | মুসুক | মাই |
তঞ্চঙ্গ্যা | এক | বেল | আঘাচ | মুরা | গাঙ | পিত্থিমী | মানুচ | চোক | গরু | ভাত |
ম্রো | লক | চাত | মুক কবাং | টাঘো | অ | লুচা | মারুসা | মিক | জিয়া | হম |
চাক | আ | চামিক | কংপ্লাক | টাং | পেসী | কাম্বা | তাসাভ্র্রাইং | আমিক | স্ফুক | পুক |
লুসাই | পাখত | নিসা | ভান | - | - | খবেল | মি | মিত | বং | চ |
বোম | পাখত | নি | ভান | কুযুং | তিভা | লাইকেল ই | মিনুং | মিত | চপে | বুহ |
পাংখো | পাখত | - | - | - | - | - | মি | মিক | - | - |
খিয়াং | হাত | নী | হন | - | হলং | লুদুল | খ্রং | মিক | সেল | বু |
খুমী | - | - | - | - | - | - | - | আমিক | - | - |
সংস্কৃতি
খুমী নৃত্য |
এতদঞ্চলের আদিবাসী সংস্কৃতি অত্যন্ত উজ্জ্বল এবং বৈচিত্রময়। এখানকার ১১টি জাতি সত্তার বিশাল সংস্কৃতির ভান্ডার রয়েছে।তারা পূর্বপুরুষদের সংস্কৃতির ধারা পরম মমতায় যুগ যুগ ধরে রক্ষা করে চলেছে। আধুনিক শিক্ষা, মোঘল-ইংরেজ-বাঙালি সংস্কৃতির ছোঁয়া, নগরায়ন ও আকাশ সংস্কৃতি আদিবাসীদের সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলকে যথেষ্ট প্রভাবিত করেছে তা ঠিক। এতে তাদের ভাষা, পোশাক, আহার ও জীবন ধারায় পরিবর্তনও লক্ষনীয়। তা সত্ত্বেও সংস্কৃতির বিচারে তাদের এখনো আলাদাভাবে চেনা সম্ভব। এ ধারা আরো অনেকদিন অব্যাহত থাকবে তা নির্দ্বিধায় বলা যায়।
পার্বত্য উপজাতি জনগোষ্ঠির মধ্যে বৌদ্ধ, সনাতন, খ্রিস্টান ও ক্রামা ধর্ম প্রচলিত। এখানে আচার সংস্কার বিষয়ে বেশ কিছু টোটেমিক ধারণা প্রতিষ্ঠিত। মন্দিরের পুরহিতদের পাশাপাশি পাহাড়ি ওঝা, বৈদ্য ও তান্ত্রিকদের প্রভাবও লক্ষ করা যায়। সমাজে প্রতিষ্ঠিত প্রাচীন রীতিনীতি মেনে চলে সবাই। লোক সংস্কার ও লোক বিশ্বাসকে মনে প্রাণে ধারণ করে সেটা থেকে শুভ-অশুভকে বিচার করা হয় কখনও কখনও। তবে বর্তমানে কুসংস্কারগুলো ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে।
পোশাক-পরিচ্ছদ ও অলংকার ব্যবহারের ক্ষেত্রে পার্বত্য আদিবাসীদের শিল্পমননশীলতার পরিচয় মেলে। চাকমাদের পিনন-খাদি, মারমাদের লুঙ্গি-থামি, ত্রিপুরাদের রিনাই-রিসা উৎকৃষ্ট শিল্পকলার পরিচয় বহন করে। সুদূর অতীতে মেয়েদের শুধু রূপার গহনা পরতে দেখা যেত। লুসাই, পাংখো ও বম মেয়েরা পরতো বাঁশ-কাঠের অলংকার। আবার কেউ কেউ পুঁতির মালা কিংবা মুদ্রার মালা পরতো। কানে পরতো দুল আর ঝুমকো। পুরুষরা পরতো মালকোচা ধুতি এবং লম্বা হাতা জামা। বর্তমানে পেশাক-পরিচ্ছদে বেশ পরিবর্তন এসেছে। এখন সকল জাতিসত্তার মেয়েদের সালোয়ার-কামিজ, শাড়ি-ব্লাউজ এবং পুরুষদের পেন্ট-শার্ট পরতে দেখা যায়।
চাকমা ও তঞ্চঙ্গ্যাদের দু’টি জনপ্রিয় পালাগানের নাম হলো ‘রাধামন-ধনপুদি পালা’ ও ‘চাদিগাং ছারা পালা’। যুবক-যুবতীদের মধ্যে ‘উভগীদ’ সবচেয়ে জনপ্রিয়। অতীতে মুহুর্মুহু রেইঙের মধ্যে সারারাত ব্যাপী গেইংখুলির পালাগান শোনা ছিল নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা। উভগীদ গাওয়া হতো জুমে, কাজের ফাঁকে ফাঁকে। ঘুমপাড়ানী গানের নাম হচ্ছে ‘অলি ডাগনি’। মারমাদের গীতি-নৃত্য-নাট্য বৌদ্ধ ধর্মীয় দর্শনের ছত্রছায়ায় গড়ে উঠেছে। ত্রিপুরাদের লোক গীতির নাম হলো ‘পুন্দা তান্নাই’ বা ‘জিজোক পুন্দা’। বর্তমানে উপজাতীয় ভাষায় আধুনিক গান রচিত হচ্ছে। গীতিকার হিসেবে খ্যাতিমান হয়েছেন সুরেন্দ্র লাল ত্রিপুরা, রনজিত কুমার দেওয়ান, সুগত চাকমা, ঈশ্বর চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা প্রমুখ। এ জেলার সঙ্গীত জগতে যাদের নাম উল্লেখযোগ্য বিমলেন্দু দেওয়ান, রনজিত কুমার দেওয়ান, মনোজ বাহাদুর, রলি দেওয়ান, আলপনা চাকমা, উত্তমা খীসা, রূপায়ণ দেওয়ান, সুরেশ ত্রিপুরা ও প্রহেলিকা ত্রিপুরা। এখানকার ঐতিহ্যবাহী বাদ্যযন্ত্রের মধ্যে রয়েছে ‘বেহালা’, ‘দুদুক’, ‘খেংগ্রং’, ‘শিঙা’ ‘বাঁশি’ ‘ডোল’ ইত্যাদি। বর্তমানে এ সব যন্ত্রের ব্যবহার কদাচিত চোখে পড়ে। এসবের জায়গা দখল করে নিয়েছে কীবোর্ড, হারমোনিয়াম, তবলা, গীটার ইত্যাদি। এখানকার
পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রধান সামাজিক উৎসব ‘বিজু-সাংগ্রাই-বৈসুক’। চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা ও তঞ্চঙ্গ্যারা বর্ষ বিদায় ও নববর্ষের আগমণ উপলক্ষে তিনদিনব্যাপী এ উৎসব পালন করে। এ বিষয়ে ‘ঐতিহ্য’ নামক কনটেন্টে বর্ণনা করা হয়েছে। চাকমাদের ‘হাল পালানী’ উৎসব কৃষি ভিত্তিক। এ সময় হালচাষ বন্ধ রাখা হয় ঋতুমতী জমির উর্বরা শক্তি বৃদ্ধির বিষয়টি বিবেচনা করে। মারমাদের ‘ছোয়াইংদগ্রী লং পোয়েহ’ ও ‘রথটানা’ উল্লেখযোগ্য। ‘খিয়াং উপজাতিদের প্রধান উৎসব ‘হেনেই’। আর ‘লুসাইদের নবান্ন উৎসবের নাম ‘চাপ চার কুট’। ম্রোদের রয়েছে ‘গো-হত্যা’ উৎসব। বর্তমানে ‘কঠিন চীবর দান’ প্রধান ধর্মীয় উৎসবে পরিণত হয়েছে।
চাকমাদের জনপ্রিয় নৃত্য হচ্ছে ‘জুমনৃত্য’। ত্রিপুরাদের ‘গরাইয়া নৃত্য’ বৈসুক উৎসবে অনুষ্ঠিত হয়। লুসাইদের লোকনৃত্যের মধ্যে ‘বাঁশ নৃত্য’ ইতোমধ্যে জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। বম ও পাংখো সম্প্রদায়ের মধ্যে এ নৃত্যের প্রচলন দেখা যায়। এতদঞ্চলের নৃত্য শিল্পীরা দেশে-বিদেশে কৃতিত্ব প্রদর্শন করেছে। উপজাতীয় নৃত্য শিল্পীদের ‘জুম নৃত্য’, ‘গরাইয়া নৃত্য’, ‘বাঁশ নৃত্য’ ও ‘বোতল নৃত্য’ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে প্রচুর প্রশংসা কুড়িয়েছে।
কাপ্তাই বাঁধ নির্মণের পূর্বে কারমাইকেল হল কেন্দ্রিক নাট্য উপস্থাপনায় রাঙ্গামাটি মুখরিত থাকতো। ব্রিটিশ আমলেও এ ধারা অব্যাহত ছিল। রাঙ্গামাটি আর্ট কাউন্সিল নাট্যচর্চার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতো। এক সময় গ্রমাঞ্চলে ‘যাত্রা’ ছিল বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম। আকাশ সংস্কৃতির এ যুগে টিভি হয়ে উঠেছে বিনোদনের প্রধান মাধ্যম। তারপরও ‘আদিবাসী মেলা’ উপলক্ষে উপজাতীয় সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে মঞ্চস্থ উপজাতীয় নাটকগুলো দর্শকদের বিনোদনের খোরাক যুগিয়ে চলেছে। এতদঞ্চলে সম্প্রতিক কালে মঞ্চস্থ উল্লেখযোগ্য নাটকসমূহ হচ্ছে সুগত চাকমার ‘ধেঙা বৈদ্য’, চিরজ্যোতি চাকমার ‘আনাত ভাজি উধে কা মু’, শান্তিময় চাকমার ‘বিঝু রামর সর্গত যানা’, মৃত্তিকা চাকমার,দেবঙসি আধর কালা ছাবা’, ‘হককানির ধনপানা’।
এতদঞ্চলের সাহিত্য চর্চার শুরু ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে রাজবাড়ি কেন্দ্রিক ‘গৈরিকা’ সাময়িকীকে ঘিরে। ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে বান্দরবান থেকে ‘ঝরণা’ প্রকাশিত হয় ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে। বিরাজ মোহন দেওয়ান সম্পাদিত ‘পার্বত্য বাণী’ আত্মপ্রকাশ করে ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দে। এ সময় যারা নিয়মিত লিখতেন তারা হলেন রাজমাতা বিনীতা রায়, সলিল রায়, মুকুন্দ তালুকদার, ভগদত্ত খীসা, সুনীতি জীবন চাকমা, কুমার কোকনাদাক্ষ রায়, অরুন রায়, বঙ্কিম কৃষ্ণ দেওয়ান প্রমুখ। ১৯৭৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে ‘সাপ্তাহিক বনভূমি’ নিয়মিত প্রকাশিত হতে থাকে। ‘দেনিক গিরিদর্পন’ পত্রিকার আত্নপ্রকাশ ১৯৮১ খ্রিস্টাব্দে। ১৯৮৮ খ্রিস্টাব্দে ‘সাপ্তাহিক রাঙামাটি’ এর প্রকাশনা শুরু। এটি ১৯৯৩ খ্রিস্টাব্দে দৈনিকে উন্নীত হয়। পার্বত্যাঞ্চলের জাতিসত্তাসমূহের নিজস্ব সাহিত্য রয়েছে। তাদের লোক সাহিত্য নানা কারণে বৈশিষ্ট্যমন্ডিত। তবে একমাত্র চাকমা ছাড়া অন্যান্য ভাষায় সাম্প্রতিক কালে সাহিত্য চর্চার তেমন উন্নতি সাধিত হচ্ছে না। চাকমা সাহিত্যের প্রাচীন নিদর্শন ‘রাধামন ধনপুদি পালা’, ‘চাদিগাং ছারা পালা’ ও ‘লক্ষী পালা’। মধ্যযুগে ‘সাদেংগিরির উপাখ্যান’, ‘গোঝেন লামা’ ও ‘বারমাসী’ উল্লেখযোগ্য। আধুনিক যুগের সাহিত্যের মধ্যে রয়েছে সুগত চাকমার ‘রাঙামাত্যা’, দীপংকর শ্রীজ্ঞান চাকমার ‘পাদারঙ কোচপানা’ সুহৃদ চাকমার ‘বাগী’ অন্যতম। এছাড়া ফেলাজেয়া চাকমা, রাজা দেবাশীষ রায়, শিশির চাকমা, শ্যামল তালুকদার, মৃত্তিকা চাকমা, জগৎ জ্যোতি চাকমা, কবিতা চাকমা, সীমা দেবান, তরুণ চাকমা, প্রবীণ খীসা কবিতা লিখছেন। সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় যারা লেখালেখি করছেন তারা হলেন বীর কুমার তঞ্চঙ্গ্যা, শান্তিময় চাকমা, ঝিমিত ঝিমিত চাকমা, মানস মুকুর চাকমা, সজীব চাকমা প্রমুখ। মারমা প্রচুর কবিতা ও গাণ লেখা হচ্ছে। ত্রিপুরা ভাষার সাহিত্যের মধ্যে ‘সিকাম কামানি’, ‘লাংগুই রাজানো বুমানি’, ‘পুন্দাতানমানি’, ‘গাঙাতলীয় থাঁমানী’, ‘হায়া বিদেশী থাঁমানী’, ‘খুম কামানী’ অন্যতম। এছাড়া ককবরক ভাষায় কবিতা ও গান লেখা হচ্ছে।
রাঙ্গামাটি জেলার সাময়িকী ও সাহিত্য চর্চা :
এতদঞ্চলে প্রযুক্তিগত সমস্যার কারণে প্রকাশনা কার্যক্রম অনেক দেরীতে শুরু হয়েছে। বিশ্বের অন্যান্য স্থানের মত পার্বত্য চট্টগ্রামেও সংবাদপত্র প্রকাশের পূর্বে সাময়িকী প্রকাশিত হয়েছিল। এতদঞ্চলের প্রথম সাময়িকী ‘গৈরিকা’ ১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দে আত্মপ্রকাশ করে। এটি ছিল চাকমা রাজবাড়ি কেন্দ্রিক। ১৯৩৬ হতে ১৯৫১ খ্রিষ্টাব্দ গৈরিকার প্রচার সংখ্যা সম্ভবত চৌদ্দ। এরপর ১৯৬৬ খ্রিষ্টাব্দে তৎকালীন মহকুমা শহর বান্দরবান হতে ত্রৈমাসিক ‘ঝরণা’ আত্মপ্রকাশ করে। ঝরণার প্রচার সংখ্যা ছিল পাঁচ। ১৯৫৯ খ্রিষ্টাব্দে বিরাজ মোহন দেওয়ানের উদ্যোগে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রথম ছাপাখানা ‘সরোজ আর্ট প্রেস’ স্থাপিত হয়। তাঁর সম্পাদনায় পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রথম মাসিক সাময়িকীপত্র ‘পার্বত্য বাণী’ ১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে আত্মপ্রকাশ করে। এটি ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দের এপ্রিল পর্যন্ত নিয়মিতভাবে প্রকাশিত হয়। এ তিনটি সাময়িকীকে কেন্দ্র করে সে সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক লেখকের আবির্ভাব হয়েছিল। উল্লেখিত সাময়িকী ছাড়াও এতদঞ্চল থেকে ১৯৪০-এ ‘প্রগতি’, ১৯৪৭-এ ‘রাঙ্গামাটি নিউজ’ এবং ১৯৬২-তে ‘রাঙামাটি’ নামক সাময়িকী বের হলেও এগুলো ছিল সল্পায়ু।
সাময়িকীপত্র প্রকাশের ৪২ বছর পর ১৯৭৮ খ্রিষ্টাব্দে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রথম সাপ্তাহিক ‘বনভূমি’ প্রকাশিত হয়। সে বছর ২৬ মার্চ হতে এ সাপ্তাহিকীটি নিয়মিতভাবে প্রকাশিত হতে থাকে। রাঙ্গামাটি শহর হতে দ্বিতীয় সাপ্তাহিক ‘সমতা’ প্রকাশিত হয় ১৯৮০ খ্রিষ্টাব্দের ২১ ফেব্রুয়ারী। ১৯৮১ খ্রিষ্টাব্দে রামগড় মহকুমা শহর থেকে সাপ্তাহিক ‘পার্বতী’-র তিনটি সংখ্যা প্রকাশিত হয়। রাঙ্গামাটি হতে সাপ্তাহিক ‘রাঙামাটি’ আত্মপ্রকাশ করে ১৯৮৮ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ মে। রাঙামাটি ১৯৯৩ খ্রিষ্টাব্দে দৈনিকে উন্নীত হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রথম দৈনিক ‘গিরিদর্পন’ ১৯৮১ খ্রিষ্টাব্দে বিশেষ সংখ্যা এবং ১৯৮২ খ্রিষ্টাব্দে দু’টি সংখ্যা বের হয়। ১৯৮৩ খ্রিষ্টাব্দ হতে এ দৈনিকটি নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে।
রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলায় সাহিত্য চর্চার ইতিহাস দীর্ঘদিনের। রাঙ্গামাটি সরকারি কলেজের প্রাক্তন সহযোগী অধ্যাপক শ্রী নন্দ লাল শর্মা তাঁর ‘প্রকাশনাঃ পার্বত্য চট্টগ্রাম ও উপজাতি’ গ্রন্থে পার্বত্য চট্টগ্রাম ও উপজাতি সম্পর্কিত গ্রন্থ ও প্রবন্ধের তালিকা সুবিন্যস্তভাবে গ্রন্থিত করেছেন। এ ছাড়াও সাম্প্রতিক সময়ে কিছু গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। নিম্নে উল্লেখযোগ্য গ্রন্থসমূহের তালিকা প্রদান করা হলোঃ-
গ্রন্থের নাম
| লেখকের নাম | প্রকাশ কাল |
চাকমা রাজবংশের ইতিহাস | রাজা ভূবন মোহন রায় | ১৯১৯ খ্রিঃ |
পার্বত্য রাজ লহরী | নোয়ারাম চাকমা | ১৯৬২ খ্রিঃ |
চাকমা জাতির ইতিহাস | বিরাজ মোহন দেওযান | ১৯৬৯ খ্রিঃ |
চাকমা পরিচিতি | সুগত চাকমা | ১৯৮৩ খ্রিঃ |
উদয়ন বস্ত্ত | কার্ত্তিক চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা | ১৯৬১ খ্রিঃ |
অন্তর্গত বৃষ্টিপাত | দীপংকর শ্রীজ্ঞান চাকমা | ১৯৭৯ খ্রিঃ |
ধর্মধ্বজ জাতক | পমলা ধন তঞ্চঙ্গ্যা | ১৯৩৭ খ্রিঃ |
অস্তিত্ববাদ ও ব্যক্তি স্বাধীনতা | ড. নিরু কুমার চাকমা | ১৯৮৩ খ্রিঃ |
থানমানা চুমুলাং গোয়েঞঃ চাকমা তঞ্চঙ্গ্যা লোকায়ত দর্শনের ভূমিকা | বীর কুমার তঞ্চঙ্গ্যা | ১৯৭৭ খ্রিঃ |
গ্রামের কল্যাণ | রাজমাতা বিনীতা রায় | ১৯৬৩ খ্রিঃ |
চাকমা ভাষা তত্ত্বের পরিচয় | প্রভাত কুমার দেওয়ান | ১৯৭৮ খ্রিঃ |
চাকমা রূপ কাহিনী | বঙ্কিম কৃষ্ণ দেওযান | ১৯৭৯ খ্রিঃ |
রাঙ্গামাটি বৈচিত্র্যের ঐক্যতান | ড. জাফর আহমেদ খান সম্পাদিত | ২০০৪ খ্রিঃ |
পার্বত্য চট্টলার এক দীন সেবকের জীবন কাহিনী | কামিনী মোহন দেওয়ান | ১৯৭০ খ্রিঃ |
ঐতিহাসিক পেক্ষাপটে পার্বত্য চট্টগ্রাম স্থানীয় সরকার পরিষদ | জ্ঞানেন্দ্র বিকাশ চাকমা | ১৯৯৩ খ্রিঃ |
চম্পক নগরের সন্ধানেঃ বিবর্তনের ধারায় চাকমা জাতি | সুপ্রিয় তালুকদার | ১৯৯৯ খ্রিঃ |
চাকমা জাতির ইতিহাস বিচার | অশোক কুমার দেওযান | ১৯৯৩ খ্রিঃ |
পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয় সংস্কৃতি | আজাদ বুলবুল | ২০০৫ খ্রিঃ |
চাকমা গল্প | মৃত্তিকা চাকমা ও সন্তোষ চাকমা সম্পাদিত | ২০০৯ খ্রিঃ |
বার্গী | সুহৃদ চাকমা |
|
A Fly on the Wheel or How I helped to Govern India | Lewin, Capt. Thomas Herbert | 1885 |
An Account of the Chittagong Hill Tracts | Hutchinson, R H Sneyd | 1906 |
Tribes of the Chittagong Hill Tracts | Bessaignet, Prof. Pierre | 1958 |
Ethnic Groups of Chittagong Hill Tracts | Bernot, Lucien | 1964 |
Linguistic Survey of Chittagong Hill Tracts | Grierson, Dr. Sir G A | 1927 |
Chakma Resistance to British Domination | Qanungo, Dr. Suniti Bhushan | 1998 |
পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে: মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, এটুআই, বিসিসি, ডিওআইসিটি ও বেসিস