একাত্তরে বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলা রাঙ্গামাটি, রামগড় ও বান্দরবান এই ৩টি মহকুমা নিয়ে গঠিত ছিল। সমগ্র জাতি যখন স্বাধীনতার সুমহান চেতনায় উজ্জ্বীবিত হয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়েপড়েছিল- পার্বত্য চট্টগ্রামবাসীরাও আন্দোলনের শরীক হয়েছিল সেদিন। অবিভক্ত পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলা সদর রাঙ্গামাটি জাতীয় রাজনীতির মূল স্রোতধারার সঙ্গে সম্পূর্ণরূপে একাট্টা হয়ে গিয়েছিল। এখানকার বাঙালীদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পাহাড়ী উপজাতীয়রাও বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে শুরু থেকেই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। সেদিন পার্বত্য জেলার মুক্তিকামী ছাত্র-জনতা স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়েপড়েছিল।
৭১ এর মার্চ মাসে রাঙ্গামাটি জেলা সদরে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়েছিলরাঙ্গামাটি সরকারী কলেজের তৎকালীন ছাত্রনেতা গৌতমদেওয়ান এবং সুনীল কান্তি দে এর নেতৃত্বে। অনুরূপভাবে ১৬ মার্চ রামগড় মহকুমার কাজী রুহুল আমিনকে আহ্বায়ক এবং সুবোধ বিকাশ ত্রিপুরাকে যুগ্ম সম্পাদক করে ২১ সদস্য বিশিষ্ট একটি সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। খাগড়াছড়িতে দোস্ত মোহাম্মদ চৌধুরীর নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। তৎকালীন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সংগে যোগাযোগ রেখে দেশের চলমান রাজনৈতিক ধারায় পার্বত্য চট্টগ্রামে বিভিন্ন কর্মসূচী পালন, রাজপথে মিছিল- েশ্লাগান, আন্দোলন, প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ এবং মুক্তি সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়াই এসব সংগ্রাম পরিষদের উদ্দেশ্য ছিল।
রাঙ্গামাটিতে ২৭ মার্চ বর্তমান রাঙ্গামাটি ষ্টেশন ক্লাবের মাঠে মুক্তিযুদ্ধের অস্থায়ী ট্রেনিং ক্যাম্প খোলা হয়। তৎকালীন জেলা প্রশাসক হোসেন তৌফিক ইমাম (এইচ.টি. ইমাম) (বাংলাদেশের প্রথম মন্ত্রিপরিষদ সচিব)স্বতঃস্ফুর্তভাবে জাতির মুক্তি আন্দোলনে শরীক হন। রাঙ্গামাটিতে উক্ত ট্রেনিং ক্যাম্প স্থাপনে জেলা প্রশাসক এইচ.টি. ইমাম, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক আবদুস সামাদ, পুলিশ সুপার বজলুর রহমান এবং মহকুমা প্রশাসক আবদুল আলীসহ রাঙ্গামাটির অগণিত স্বাধীনতা প্রেমিক মানুষ এগিয়ে এলেন প্রাণঢালা অকুন্ঠ সমর্থন দিয়ে।রাঙ্গামাটি ষ্টেশন ক্লাবের মাঠে শুরু হয় রাইফেল ট্রেনিং এবং ছাত্রদের ককটেল বানানোর প্রশিক্ষণ। জেলা প্রশাসকের সম্মতিক্রমে রাঙ্গামাটি সরকারী কলেজের বিজ্ঞানাগারে রসায়ন বিভাগের যাবতীয় কেমিক্যাল ব্যবহৃত হলো এই কাজে।
স্থানীয়ভাবে যখন মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি চলছিল তখনই রাঙ্গামাটিতে জেলা প্রশাসকের সরকারী বাংলোতে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের উপস্থিতিতে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা এবং দিক-নির্দেশনা দেয়া হয়।এতে রাজনৈতিক এবং ছাত্র নেতৃবৃন্দ আরো বেশী অনুপ্রাণিত এবং সুসংগঠিত হন।
২৯ মার্চ রাঙ্গামাটি হতে ছাত্র-যুবকের ৬০ জনের একটি দল ভারতে রওনা হয় প্রশিক্ষণ গ্রহণ করার জন্য।ইতোমধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন সীমান্তএলাকায় কর্মরত ইপিআর এর বাঙালী অফিসার ও জোয়ানরা এলেন রাঙ্গামাটিতে।তাঁরা চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলেন মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবেঅংশ নিতে।তাঁদের জন্য রসদ সরবরাহ, যানবাহনের ব্যবস্থাপনার জন্য রাঙ্গামাটি আলম ডকইয়ার্ডেগড়ে উঠল মুক্তি বাহিনীর অস্থায়ী ক্যাম্প ।এখানে স্থাপন করা হল ওয়ারলেস সেন্টার।এখান থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকা এবং চট্টগ্রামে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রক্ষা করা হত ওয়ারলেসের মাধ্যমে।মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য খাবার রান্না করা হত এই ডকইয়ার্ডেই।রাঙ্গামাটির নেতৃবৃন্দ এবং ছাত্র নেতারা স্বতঃস্ফুর্তভাবে এগিয়ে এলেন- শুরু হল মুক্তিযুদ্ধ।চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং কালুরঘাটে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য রসদ সরবরাহ করা হল রাঙ্গামাটি থেকে।রাঙ্গামাটিবাসীরা উদার হস্তেএগিয়ে এলেন মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্যার্থে।
রাঙ্গামাটি হতে ভারতে যাওয়া প্রথম মুক্তিযোদ্ধা দলটি এক সপ্তাহের প্রাথমিক প্রশিক্ষণ শেষে ক্যাপ্টেনআবদুল কাদেরের নেতৃত্বে রামগড় সীমান্তদিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে ১০ এপ্রিলে।রামগড় মহকুমা তখন মুক্ত অঞ্চল ছিল।সেখানে ৪ দিন অবস্থানের পর তাঁরা ৩টি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে মহালছড়ি হয়ে রাঙ্গামাটি শহরের দিকে এগিয়ে যায় ১৫ এপ্রিলে।কিন্তুঅত্যন্তদুঃখজনক হলেও সত্যি যে,স্থানীয়কিছু লোকের বিশ্বাসঘাতকার কারণে ঐ দিনই পাকিস্তানী বর্বর বাহিনী রাঙ্গামাটিতে এসে অবস্থান নেয় চুপিসারে- যা মুক্তিযোদ্ধাদের জানা ছিল না।ফলে মুক্তিযোদ্ধাদের একটিদলরাঙ্গামাটিস্থজেলা প্রশাসকের বাংলোর কাছাকাছি এলে সেখানে অবস্থানরত পাক বাহিনী তাঁদের অস্ত্রসহ ধরে ফেলে।এই দলে ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা রাঙ্গামাটির আবদুল শুক্কুর, এস.এম. কামাল, শফিকুর রহমান, ইফতেখার, ইলিয়াস, আবদুল বারী, মোঃ মামুন ও আবুল কালাম আজাদ।ধৃত মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে একমাত্র আবুল কালাম আজাদ ও ফুড ইন্সপেক্টর আবদুল বারী ছাড়া অন্যদের পাকবাহিনীনির্মমভাবে অত্যাচার চালিয়ে রাঙ্গামাটির মানিকছড়িতে নিয়ে গিয়ে হত্যা করে।কালাম নৌকা চালকের ভূমিকায় অভিনয় করে পাক সেনাদের ফাঁকি দিয়ে কোন মতে প্রাণে বাঁচে।মুক্তিবাহিনীর অপর ২টি দলের মধ্যে ১টি দল রাঙ্গামাটি আলম ডকইয়ার্ডে উঠে।সেখানকার টেলিফোন সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে তাঁরা সেখানে অবস্থান নেয় এবং অপর দলটি রাঙ্গামাটি শহরে পাক সেনাদের চলাফেরা টের পেয়ে রাঙ্গামাটি হ্রদে অবস্থান গ্রহণ করে।পরে দলসমূহ রাঙ্গামাটি শহর ছেড়ে বাকছড়িতে অবস্থান গ্রহণ করে এবং পরদিন বাকছড়ির অবস্থান থেকে টহলরত পাকবাহিনীর উপর হামলা চালায়।
২ এপ্রিল পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক হোসেন তৌফিক ইমাম তৎকালীন রামগড় মহকুমা সদরে আসেন।তিনি সঙ্গে করে প্রচুর অর্থ নিয়ে আসেন এবং পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী বিপ্লবী সরকারের হাতে তুলে দেন।রামগড় মহকুমাতে তিনি বাংলাদেশ সরকারের অধীনে প্রশাসনিক কার্য পরিচালনা করেন।পরবর্তীতে তিনি রামগড় সীমান্ত অতিক্রমকরে ভারতের ত্রিপুরার সাব্রুম মহকুমাতে চলে যান এবং ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সহযোগিতায় রাঙ্গামাটিতে এসে পুলিশ, আনসার ও ইপিআরদের সমস্তঅস্ত্রশস্ত্রমুক্তিযোদ্ধাদের মাঝে বিলি বন্টনের ব্যবস্থানেন।তাঁর নির্দেশেই এডিসি সামাদ বরকল সীমান্তপার হয়ে ভারতের দেমাগ্রীতে গিয়ে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করেন এবং মুক্তিযুদ্ধের সার্বিক দায়িত্ব পালন করেন।তাঁদের অনুপস্থিতিতে মহকুমা প্রশাসক আবদুল আলী রাঙ্গামাটিতে যাবতীয় দায়িত্ব পালন করতেন।পরবর্তীতে ভারতের উদ্দেশ্যে রাঙ্গামাটি ত্যাগের সময় তিনি পাকবাহিনীর হাতে ধরা পড়েন।মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তাঁর নামানুসারে কায়দে আজম মেমোরিয়াল একাডেমীর নাম পরিবর্তন করে শহীদ আব্দুল আলী একাডেমী নামকরণ করা হয়। বর্তমান পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড কার্যালয় সংলগ্ন এলাকায় শহীদ আব্দুল আলীর স্মৃতিস্তম্ভরয়েছে।
প্রয়াত মং রাজা মংপ্রু সাইন চৌধুরী বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণের জন্য মানিকছড়ি রাজবাড়ী ছেড়ে ভারতে চলে যান এবং পার্বত্য এলাকায় মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার ক্ষেত্রে মূল্যবান পরামর্শ ও অন্যান্য সহযোগিতা প্রদান করেন।তিনি সর্বপ্রথম বিপ্লবী সরকারের হাতে বৈদেশিক মুদ্রাতুলে দেন। পাকবাহিনী ১৫ এপ্রিলে রাঙ্গামাটি জেলা সদরদখল করার পর পরই বান্দরবান মহকুমা দখল করে নেয়এবং২৭ এপ্রিল খাগড়াছড়ি ও ২ মে রামগড় মহকুমা সদর এলাকা দখল করে।
পাকবাহিনী ২০ এপ্রিল বুড়িঘাট-নানিয়ারচর হয়ে মুক্তিবাহিনীর মূল প্রতিরক্ষা কেন্দ্র মহালছড়ির দিকে অগ্রসর হবার চেষ্টা চালায়। এ সময় ৮ম ইষ্ট বেঙ্গলের একটা অংশ এবং তৎকালীন ইষ্ট পাকিস্তান রাইফেলস্ এর কতিপয়সদস্য পার্বত্য চট্টগ্রামে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধরত ছিল। ঐদিন ল্যান্স নায়েক মুন্সী আবদুর রউফ বুড়িঘাট অঞ্চলের চিংড়ি খালের প্রতিরক্ষায় নিয়োজিত কোম্পনীর মেশিন গানার হিসাবে রাঙ্গামাটি-মহালছড়ি নৌপথে প্রহরারত ছিলেন।পাকবাহিনীর ২য় কমান্ডো ব্যাটালিয়নের সদস্যরা সেদিন মুক্তিবাহিনীর প্রতিরক্ষা এলাকায় ঢুকে পড়ে। মুক্তিবাহিনীকে দেখা মাত্র শত্রু সৈন্যরা ৩ ইঞ্চি মর্টার ও অন্যান্য অস্ত্র দিয়ে গোলাবর্ষণ শুরু করলে মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা বিক্ষিপ্ত হয়ে যায়। একমাত্র মুন্সী আবদুর রউফ তাঁর নিজের অবস্থান থেকে মেশিনগান দিয়ে শত্রুর উপর গোলাবর্ষণ অব্যাহত রাখেন- যার ফলে শত্রুর ২টি লঞ্চ ও ১টি স্পীড বোট পানিতে ডুবে যায় এবংএকপ্লাটুন শত্রু সৈন্য সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়। অক্ষত নৌযানগুলোতে অবশিষ্ট শত্রু সৈন্যরা পশ্চাদপসরণ করে। শত্রুর প্রবল গোলাবর্ষণের মুখেও মুন্সী আবদুর রউফ তাঁর মেশিনগান দিয়ে নিজের অবস্থানে স্থির ছিলেন। কিন্তু হঠাৎ করেই বিপক্ষের মর্টারের গোলা তাঁর অবস্থানে আঘাত করলে তিনি শাহাদাত বরণ করেন। তার অসীম বীরত্বপূর্ণ পদক্ষেপের ফলে পাকবাহিনী মহালছড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের মূল প্রতিরক্ষা বুহ্যের দিকে অগ্রসর হতে পারেনি। মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অবদানকে শ্রদ্ধা জানাতে ১৯৯৭ সালে নানিয়ারচরেরবুড়িঘাটে তাঁর সমাধির উপর স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়।
পাকবাহিনী ২৭ এপ্রিল পুনরায় রাঙ্গামাটি থেকে মহালছড়ি অভিমুখে জলপথে অগ্রসর হয়।তখন মহালছড়িতে মেজর মীর শওকতের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীরা প্রতিরক্ষাবুহ্য গড়ে তোলে।সেখানে বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করে মুক্তিবাহিনীর ক্যাপ্টেনআবতাবুল কাদের গুলিবিদ্ধ হন।তিনি ৭ পাক সেনাকে ঘায়েল করেন।বীর উত্তম খেতাবপ্রাপ্ত ক্যাপ্টেনআবতাবুল কাদেরকেরামগড়ে নেয়ার পথেতিনিমারাযান।তাঁকে রামগড়ে কবর দেয়া হয়।মহালছড়ি দখল করার দিনই পাকবাহিনীরা খাগড়াছড়িও দখল করে নেয়।
মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই রামগড় মহকুমা সদর হয়ে উঠেছিল মুক্তিযুদ্ধের পীঠ স্থান।রামগড় উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ট্রেনিং ক্যাম্পস্থাপিত হয়।মুক্ত এলাকায় এটিই ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের প্রথম ট্রেনিংক্যাম্প।এখানে মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং চলার সঙ্গে সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা সংগ্রহ অভিযানও পরিচালিত হয়। রামগড় পতনের আগ পর্যন্তসেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ছিল। তৎকালীন ভারতের সীমান্তএলাকায় অবস্থিত রামগড় মহকুমা সদর থেকে তখন চট্টগ্রাম, শুভপুর, মহালছড়ি এবং অন্যান্য এলাকায় পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করা হত।১ মে পর্যন্তরামগড় সদর ছিল মুক্ত এলাকা এবং মুক্তিযোদ্ধাদের শক্তিশালী ঘাঁটি।
বর্বর পাক বাহিনীরা রামগড় দখল করার জন্য ত্রিমুখী আত্র্রমণ পরিচালনা করে।তৎকালীন সময়ে করেরহাট থেকে রামগড় পর্যন্ত৩০ কিঃ মিঃ সরাসরি পাকা রাস্তা বিদ্যমান ছিল এবং এ এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের সুদৃঢ় অবস্থান ছিল।চট্টগ্রামের করেরহাট হয়ে রামগড় দখল করতে পাকবাহিনীর ৭ দিন সময় লাগে।পাকবাহিনীরা এ সড়কে সাঁজোয়া বহর ও ট্যাংক ব্যবহার করে।তাদেরকেমুক্তিযোদ্ধাদের প্রবল প্রতিরোধের সম্মুখীন হতে হয়।পাকবাহিনীর অগ্রযাত্রা রোধের জন্য মুক্তিবাহিনীরা করের হাট- রামগড় সড়কের মাঝপথে একটি পাকা সেতু উড়িয়ে দেয়।অবশেষে ২ মে বিকেল ৪টায় রামগড় মহকুমার পতন ঘটে।পাকবাহিনীরা রামগড় পুলিশ ষ্টেশন, রামগড় মহকুমা হাসপাতাল, রামগড় বাজার এবং সীমান্তএলাকার সমস্ত ঘরবাড়ী জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ধ্বংসলীলায়মেতে উঠে।তারা রামগড় দখল করার পর জঘন্যতম হত্যাকান্ডে মেতে উঠে এবং রামগড় হতে ভারতেচলাচলের জন্য নির্মিত সংযোগ ব্রীজটি ভেঙ্গে দেয়।
পাক বাহিনীরা পার্বত্য জেলা সদর রাঙ্গামাটি ও মহকুমা সদর রামগড় এবং বান্দরবান দখল করার পর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানসমূহে ঘাঁটি স্থাপন করে এবং ঘাঁটিসমূহ সুদৃঢ় করে নেয়।তারা বিভিন্ন এলাকায় শাখাকমিটি গঠনকরে তাদের মাধ্যমে পার্বত্য এলাকায় রাজাকার বাহিনী ও হিলরাজ বাহিনী গঠনকরে এবং বিভিন্ন এলাকায় হানা দিয়ে বর্বর অত্যাচার চালায় ও ঘরবাড়ী জ্বালিয়ে দেয়।পাকবাহিনী রামগড়, গুইমারা, মানিকছড়িসহ বিভিন্ন ক্যাম্পে পাহাড়ী রমনীদের জোর পূর্বক ধরে নিয়ে অমানুষিকভাবে ধর্ষণ করে এবং ক্যাম্পে উলঙ্গ অবস্থায় বন্দী করে রাখে।
১নং সেক্টরের আওতায় সর্বপ্রথম ৫ মে ২৫ সদস্য বিশিষ্ট পার্বত্য চট্টগ্রামের মুক্তিযোদ্ধা দল গঠনকরা হয়।এই দল গঠনের নেতৃত্ব দেন হেমদা রঞ্জন ত্রিপুরা।এটি পরবর্তীতে একটি পূর্ণাঙ্গ কোম্পানী হিসেবে স্বীকৃতি লাভকরে।শ্রী ত্রিপুরাকে কোম্পানী কমান্ডার হিসেবে নিযুক্ত করা হয়।এই কোম্পানীর অধীনে গ্রুপ নং- ৯১, ৯২, ৯৩, ৯৪ এবং ৯৫ সংযুক্ত করা হয়।উক্ত গ্রুপগুলির ট্রেনিং কেন্দ্র ছিলভারতের অম্পি নগর এবং ১নং সেক্টর হেডকোয়ার্টার হরিণা।১নং সেক্টরের অধীনে হরিণা থেকে ৩০ কিঃ মিঃ দূরবর্তী সীমান্তএলাকা ভারতের বৈষ্ণবপুরে আগস্ট মাসের প্রথম দিকে সাব-সেক্টর স্থাপন করা হয়।সেখানে অবস্থানরত গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় গেরিলা আক্রমণপরিচালনা করা হয়।পার্বত্য এলাকায় অবস্থানের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদের চলাচলের সুবিধা, শত্রুপক্ষের ঘাঁটি আক্রমণএবং পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনার সুবিধার্থে বর্তমান খাগড়াছড়ি জেলার অন্তর্গত নাকাপা, কুমারীপাড়া, পাগলা পাড়া, মানিকছড়ি, ডাইনছড়ি, যোগ্যাছলাও গাড়ীটানা এলাকার গহীন অরণ্যে মুক্তিবাহিনীর গোপন ক্যাম্প বা আশ্রয়স্থল করা হয়। এই সমস্তগোপন গেরিলা ক্যাম্পে ঐ এলাকার হেডম্যান কার্বারীসহ সকল স্তরের জনগণ খাদ্যশস্য সরবরাহ করত এবং মুক্তিযুদ্ধকালীন ঐ সমস্তএলাকার জনগণ মুক্তিযোদ্ধাদেরকে পাকবাহিনীর গতিবিধি এবং তাদের অবস্থান সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সরবরাহ করে সাহায্য করত।
মুক্তিযুদ্ধচলাকালীন ভারতের হাফলং এ অবস্থিত বিএসএফ ট্রেনিং সেন্টার হতেট্রেনিং প্রাপ্তদের একটি দল মুক্তিযোদ্ধা গ্রুপ কমান্ডার নাজিম উদ্দিনের নেতৃত্বে ৯ ডিসেম্বর কাউখালী উপজেলার অন্তর্গত বেতবুনিয়া ও বালুখালীতে গেরিলা অপারেশন পরিচালনা করে।এ যুদ্ধে গ্রুপ কমান্ডার নাজিম উদ্দিন এবং মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ জাফর শহীদ হন।১১ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধা মাহবুব আলম চৌধুরীর নেতৃত্বে বেতবুনিয়াস্থচট্টগ্রাম-রাঙ্গামাটি সড়কে অবস্থিত কালভার্টের উপর অতর্কিতভাবেপাকবাহিনীর জীপ গাড়ির উপর গেরিলাআক্রমণ চালানো হলে ঘটনাস্থলে গাড়ীর ড্রাইভারসহ ২জন পাক অফিসারের মৃত্যু ঘটে।উক্ত গেরিলা যুদ্ধে গ্রুপ কমান্ডার মাহবুব আলম চৌধুরী বাম পায়ে আঘাত প্রাপ্ত হন।
মুক্তিযুদ্ধকালীন রাঙ্গামাটি জেলার বিলাইছড়িতে অবস্থিতফারুয়া ও শুকরছড়ির মোহনায় পাক সামরিক ঘাঁটি ছিল।সেখানে পাঞ্জাবী, রাজাকার, আলবদরসহ ২৫০ জন সৈন্য অবস্থান করত।সেখানে পাক সেনাবাহিনীর কয়েকটি স্টীমার ও গানবোটও ছিল।আগস্টের মাঝামাঝি সময়ে পাইলট মান্নানসহ মুক্তি বাহিনীর একটি দল পাহাড়ী এলাকায় পথ হারিয়ে রাতের অন্ধকারে ফারুয়াস্থপাক বাহিনীর ক্যাম্পের অভ্যন্তরে এসে পড়ে।তারা চাকমাদের সহায়তায় নৌকায় করে শুকরছড়ি এলাকায় নিরাপদ স্থানে পৌঁছে যায়।জানা যায়, ফারুয়া এলাকায় কয়েকশত মুক্তিযোদ্ধা পাকবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে নৃশংসভাবে শাহাদাৎ বরণ করে।ফারুয়ারজালিয়াপাড়া নামক স্থানে সুলতান আহম্মদ কুসুমপুরীর নেতৃত্বাধীন মুক্তি বাহিনীরাও পাক বাহিনী দ্বারা আত্র্রান্তহয়েছে বলে জানা যায়।পাক বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে সুবেদার টি.এম. আলী এখানেই শহীদ হন।এই যুদ্ধে সুবেদার আবু ইসলাম দোহাজারী এবংসুলতান আহম্মদ কুসুমপুরী আহত হন।পরবর্তীতে মিত্র ও মুক্তি বাহিনী ফারুয়াস্থপাকবাহিনীর ক্যাম্পে আক্রমণ চালিয়ে বিনা রক্তপাতে ফারুয়া দখল করে নেয়।সেখানে অবস্থানরত রাজাকার, আলবদররা সাদা পতাকা উত্তোলন করে মিত্র ও মুক্তিবাহিনীর নিকট আত্মসমর্পন করে।
বর্তমান রাঙ্গামাটি জেলার বরকলে পাকবাহিনীর সামরিক অবস্থানের উপর ১৪ ডিসেম্বর সকাল ১০ টায় বাংলাদেশ বিমান বাহিনী ২টি যুদ্ধ বিমানযোগে আক্রমণচালায়।সেখানে ৭৫০ জন পাক সেনার সুদৃঢ় অবস্থন ছিল।অন্যদিকে মিত্র ও মুক্তিবাহিনীরা জৈলানন্দ সিং এবং সুলতান আহমদ কুসুমপুরীর নেতৃত্বে প্রায় ৫০০ মুক্তিযোদ্ধা বরকল অভিমুখে অগ্রসর হতে থাকে।ঐ দিন ফারুয়ায় অবস্থানরত ছদ্মবেশী পাঞ্জাবীরা জয় বাংলাশ্লোগান দিয়ে টহলদার গানবোট যোগে ফারুয়া থেকে বরকলের দিকে এগোনোর সময় মুক্তিবাহিনী মহিউদ্দিন গ্রুপের উপর আচমকা আক্রমনকরলে এখানে বেশ কিছু সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা শাহাদাত বরণ করেন।তবে মুক্তিযোদ্ধাদের পাল্টা আক্রমনেপাঞ্জাবীরা পালিয়ে যায়।১৫ ডিসেম্বর মিত্র ও মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা ভোরবেলায় বরকলে পাকবাহিনীর অবস্থানের উপর আক্রমনশুরু করে।যৌথবাহিনী রকেট লাঞ্চার ও এলএমজি থেকে অনবরত গুলি চালিয়ে যেতে থাকে।পাঞ্জাবীরাও যৌথ বাহিনীর উপর সেলিং করতে থাকে।সকাল থেকে বিকাল ৩ টা পর্যন্তউভয় পক্ষেতুমুল যুদ্ধ চলে।এতে যৌথবাহিনী ত্রিমুখী আক্রমনপরিচালনা করে।যৌথবাহিনীর আক্রমনেটিকতে না পেরে পাঞ্জাবীরা রাঙ্গামাটির উদ্দেশ্যে ষ্টীমারযোগে বরকল ত্যাগ করে।এসময় তারা তাদের অনুসারী বাঙালী রাজাকার, আলবদর ও বেলুচ সৈন্যদের যুদ্ধরত অবস্থায় বরকলে রেখে যায়।পাঞ্জাবী সৈন্যদের পশ্চাৎগমণে যুদ্ধরত সৈন্যরা মনোবল হারিয়ে ফেলে।ফলে ঐ দিন সন্ধ্যার বেশ পূর্বে পাকবাহিনীর সদস্যরাসাদা পতাকা উত্তোলন করে যৌথবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পন করে।বরকলে পাঞ্জাবীদের শক্তিশালী ঘাঁটি এইভাবে মুক্তিবাহিনীর দখলে চলে আসে।এ যুদ্ধে অনেক পাঞ্জাবী গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা পড়ে।জানা যায়, এই ঘাঁটি দখল করতে ভারতীয় মিত্র ও মুক্তিবাহিনীর অনেক সদস্য শহীদ হন।এই ঘাঁটি দখলের পর মিত্রবাহিনীর পূর্বাঞ্চল কমান্ডের অধিনায়ক জেনারেল সুজন সিং ওভান বরকল পরিদর্শন করেন।১৫ ডিসেম্বর মিত্রবাহিনীরাঙ্গামাটি দখল করে নেয়।সর্বস্তরের রাঙ্গামাটিবাসী মিত্র ও মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের প্রাণঢালা অভ্যর্থনা জানায়। রাঙ্গামাটিতে তারা বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন।১৭ ডিসেম্বর মিত্র বাহিনীর পূর্বাঞ্চল কমান্ডের অধিনায়ক জেনারেল সিং ওভান এবংশেখ ফজলুল হক মনি ভারতীয় হেলিকপ্টারযোগে রাঙ্গামাটির পুরাতন কোর্ট বিল্ডিং মাঠে অবতরণ করেন।এখানে তাঁদের অভ্যর্থনা জানান তৎকালীন ছাত্রনেতা গৌতম দেওয়ান, আবদুর রশীদ, মোঃ ফিরোজ আহম্মদ, মনীষ দেওয়ান (পরবর্তীতে কর্ণেল) সহহাজারো ছাত্র-জনতা।
বীর মুক্তিযোদ্ধাগণের তালিকা :
জীবত মুক্তিযোদ্ধা
১। জনাব মোঃ আব্দুল সবুর, পিতা- মৃত চান মিঞ্চা, ২। জনাব এন্তাজ আলী, পিতা- মোঃ আরব আলী, ৩। জনাব নুরুল ইসলাম, পিতা- মৃত আলী মিঞা মুন্সি, ৪। জনাব আব্দুল হালিম, পিতা- আলী আহাম্মদ, ৫। জনাব মোঃ আমির আহাম্মদ, পিতা- মৃত আব্দুল হাকিম, ৬। জনাব মোঃ আজিজুর রহমান, পিতা- মৃত হাজী তৈয়ব আলী, ৭। জনাব কামাল উদ্দিন, পিতা- মৃত আব্দুল হামিদ, ৮। জনাব আব্দুল মতিন, পিতা- মৃত সিরাজুল হক, ৯। জনাব মোক্তার আহম্মদ, পিতা- মৃত মোজাফর, ১০। জনাব ফরিদ আহাম্মদ, পিতা- মৃত সাহেব মিয়া, ১১। জনাব আব্দুল লতিফ, পিতা- মৃত বাচা মিয়া, ১২। জনাব মোহাম্মদ হোসেন, পিতা- মৃত গোলাম আলী
মৃত মুক্তিযোদ্ধা
১। মোঃ মফিজুর রহমান, ২। আবু ছৈয়দ, ৩। সৈয়দ নুর, ৪। ইদ্রিস আলী, ৫। মোঃ সামসুদ্দিন, ৬। আব্দুল হামিদ, ৭। মজিবর রহমান, ৮। আবুল বশর, ৯। আব্দুস সবুর, ১০। আব্দুর রাজ্জাক, ১১। আব্দুল ছামাদ ও ১২। আবুল কালাম
পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে: মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, এটুআই, বিসিসি, ডিওআইসিটি ও বেসিস